পিঠা : শীতের আনন্দ

ড. মোঃ আমিনুল হক ভূঁইয়া

সুজলা-সুফলা আমাদের এই বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ হিসেবেও সুপরিচিত। ঋতুচক্রের পালাবদলের খেলায় ঋতুরাজ বসন্তের আগেই শীতের আবির্ভাব; বাতাসে শীতের আমেজ আসা মাত্রই গ্রাম-বাংলার বাড়িতে নতুন ধানের পিঠা খাওয়ার উৎসব শুরু হয়। সব মহিলারা ব্যস্ত হয়ে পড়েন শীতের পিঠা বানাতে। কেউবা চাল বাটেন, কেউবা গুঁড়ো পিষেণ, আবার কেউবা নারিকেল কুরেন। কত রকমের কত আকৃতির যে পিঠা তৈরি হয় তার কোন হিসেব নেই। যেমন ভাপা, চিতই, রস চিতই, হাতে তৈরি সেমাই, পাটিসাপটা, হাত-কাটা পোয়া, মালপোয়া ইত্যাদি। এছাড়াও নানা ধরনের তেলে ভাজা পিঠা উল্লেখযোগ্য। গ্রামের মত শহরে বাড়িতে বাড়িতে পিঠা খাওয়ার উৎসব না থাকলেও এখানে দেখা যায় শ্রমজীবী মানুষেরা চাটনি, গুড় অথবা শুঁটকির ভর্তা দিয়ে চিতই পিঠা খাচ্ছে। বিকেলে রাস্তার মোড়ে ভাপা পিঠা আর মধ্যবিত্তের রান্না ঘরে মাঝেমধ্যে পাটিসাপটা আর তেলের পিঠা বানানো হয়।

উপকরণ সমূহ: শীতকালীন পিঠা আবহমান বাংলার ঐতিহ্য। সাধারণত পিঠা তৈরিতে দুধ, ছানা, মালাই ক্ষিরসা, চিনি, আটা, ময়দা, চালের গুঁেড়া, তেল, নারিকেল, গুড় প্রভৃতির প্রয়োজন। তবে প্রকৃতি ভেদে পিঠার উপকরণ বিভিন্ন রকমের হয়।

পুষ্টিগুণ: শীতকালীন পিঠা অত্যন্ত পুষ্টিগুণসম্পন্ন দেশীয় খাবার-যা ছেলে-বুড়ো সকলের কাছেই জনপ্রিয়। নিচে আমাদের দেশের কয়েকটি জনপ্রিয় পিঠার পুষ্টিগুণ আলোচনা করা হল:

(১) ভাপা: ভাপা পিঠার প্রধান উপকরণ চালের গুঁড়ো, গুড় এবং নারিকেল। প্রতি ৪০-৫০ গ্রাম ওজন সম্পন্ন একটি পিঠা হতে ১৪০-১৫০ কিলোক্যালরি বা খাদ্যশক্তি পাওয়া যায়। গুড়ের পরিমাণ বৃদ্ধি করলে খাদ্যশক্তির পরিমাণও বৃদ্ধি পাবে। ভাপা পিঠার প্রচুর পরিমাণ বি-ভিটামিন, খনিজ লবণ ও আঁশ থাকে যা রসনা তৃপ্তির পাশাপাশি আমাদের স্বাস্থ্যও ভালো রাখে।

(২) চিতই: চিতই পিঠাতে রয়েছে ময়দা, চালের গুঁড়া প্রভৃতি। এই পিঠাটি খাদ্যশক্তি সম্পন্ন। প্রতি ৩০-৪০ গ্রাম পিঠা হতে প্রায় ১২০ কিলোক্যালরি বা খাদ্যশক্তি পাওয়া সম্ভব। এই পিঠা গ্রাম ও শহরাঞ্চলের সব মানুষের কাছে মোটামুটি জনপ্রিয়। এতে রয়েছে বি-ভিটামিন যা আমাদের এনজাইমের কার্যকারিতা স্বাভাবিক রাখে। এছাড়া রয়েছে একাধিক খনিজ লবণ। রস-চিতই, চিতই পিঠার মত পুষ্টিগুণ সম্পন্ন কিন্তু এতে চিনি এবং দুধ দেয়ার ফলে আশিষ এবং খাদ্যশক্তির পরিমাণ আরও বৃদ্ধি পায়। এটি ব্যয়বহুল তবে মধ্যবিত্তের পরিবারে একটি শীতকালীন সকালের মজাদার খাবার।

(৩) পাটিসাপটা: আমাদের সকলের কাছেই অত্যন্ত প্রিয় পুষ্টিকর পিঠা হচ্ছে পাটিসাপটা। এর প্রধান উপকরণ হচ্ছে ক্ষিরসা,নারিকেল, চালের গুঁড়া, ময়দা, চিনি, তেল প্রভৃতি। পাটিসাপটা ক্যালসিয়ামের একটি ভালো উৎস। প্রতি ৪০-৫০ গ্রাম ওজনের পিঠায় প্রায় ১৮০ মিলিগ্রাম ক্যালসিয়াম থাকে এবং এ থেকে প্রায় ১৪০-১৮০ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি পাওয়া সম্ভব। এছাড়াও ভিটামিন-এ, ডি, ই প্রভৃতি ও বি-ভিটামিন এবং খনিজ লবণ থাকে যা আমাদের বিভিন্ন অপুষ্টিজনিত রোগ থেকে রক্ষা করে। বর্তমানে খেজুরের গুড়ের তৈরি পাটিসাপটা পিঠা শহরাঞ্চলে বেশ জনপ্রিয়, তবে খরচের জন্য নিম্নবিত্তরা এই পিঠার স্বাদ সাধারণত গ্রহণ করতে অপারগ হন।

(৪) কাটা পিঠা: সিদ্ধ ডাল বেটে চালের গুঁড়োর সাথে খামির তৈরি করে রাত্রিকালীন রেখে পরবর্তীতে ছাঁচে ফেলে এবং তেলে ভেজে সুন্দর ডিজাইনের পিঠা তৈরি করা হয়। এই পিঠা গুড়ের রসে ভিজিয়ে পরিবেশন করা হয়। এটি সাধারণত মচমচে হয়ে থাকে এবং শুকনো অবস্থায় অনেক দিন ধরে সংরক্ষণ করা যায়। একটি ৪০-৫০ গ্রাম কাটা পিঠা গুড়ের রসে ভিজিয়ে অথবা চিনি ছিটানো অবস্থায় গ্রহণ করলে তা থেকে প্রায় ১৬০-২০০ কিলোক্যালরি খাদ্যশক্তি পাওয়া যায়। এটি একই সঙ্গে বি-ভিটামিন এবং খনিজ লবণের যোগান দেয়।

পরিশেষ: সব পিঠাই কমবেশি পুষ্টিকর। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, এদের উপকরণ সংগ্রহ ও বানানোর সময় অবশ্যই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা মেনে চলতে হবে। কারণ পিঠা তৈরিতে যে দুধ বা দুগ্ধজাতীয় পদার্থ ব্যবহৃত হয় তা সহজেই অণুজীব দ্বারা আক্রান্ত হতে পারে। দূষিত খাবার খেলে খাদ্য বিষক্রিয়াসহ ডায়রিয়া হতে পারে যা পুষ্টি প্রদানের পরিবর্তে দেহ হতে সঞ্চিত পুষ্টি বের করে নিতে পারে। অনুরূপভাবে তেলে ভাজা পিঠার ক্ষেত্রে অতিরিক্ত তেল, পোড়া তেল অথবা দীর্ঘ সময় ধরে ভাজা থেকে সাবধানতা অবলম্বন করতে হবে-কারণ এতে পিঠা থেকে প্রাপ্ত পুষ্টিগুণাগুণ নষ্ট হয়ে যেতে পারে এবং পেটের নানাবিধ অসুখ হতে পারে। একই সঙ্গে স্বাভাবিক খাবারের সঙ্গে সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের অন্যান্য পিঠা যেমন: পুলি পিঠা, মেরা পিঠা, কড়ি পিঠা ইত্যাদিও অনেক অঞ্চলে শীতকালীন খাবার অর্থাৎ উৎসবের আমেজে তৈরি হয় এবং মেহমানদেরকে সমাদর করা হয়। কাজেই সঠিক নিয়মে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার মাধ্যমে শীতের পিঠা তৈরি ও গ্রহণ করে আমরা আমাদের চিরায়িত ঐতিহ্য বজায় রাখব এবং সেই সাথে পুষ্টিকর জাতিগঠনে সহায়তা করব-এই হোক আমাদের কামনা।

[লেখক : অধ্যাপক, পুষ্টি ও খাদ্য বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়]
দৈনিক ইত্তেফাক, ২০ জানুয়ারি, ২০০৯। লিংক
পিঠা : শীতের আনন্দ পিঠা : শীতের আনন্দ Reviewed by Aaron on 10:03 PM Rating: 5

No comments:

Powered by Blogger.